ক্ষমাশীল শিক্ষকদের দায়:
মাধ্যমিক পর্যায়ের (৬ষ্ঠ-দশম) শিক্ষা জীবনে আমাদের ব্যাচটি অন্যরকম ছিল। ছাত্র সংখ্যা, ভালো ছাত্র সংখ্যা, খেলাধুলায় পারদর্শী ছাত্র সংখ্যা এমনকি প্রতিবাদী ছাত্র সংখ্যা অন্যান্য অনেক ব্যাচ থেকেই বেশি ছিল। সেকারণে আমাদের ক্লাশে সম্মানিত শিক্ষকদের ভালোবাসা প্রাপ্ত ছাত্র সংখ্যাও তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল সম্ভবত আমাদের বিদ্যালয়ের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম। এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে তা বিদ্যালয় কতৃপক্ষ বা আমরা ছাত্ররা কখনও খুঁজে দেখেছি কি-না জানিনা। আমাদের ব্যাচের আমরা গর্ব করার মতো ছাত্রছাত্রীরা আজ শিক্ষক এবং অভিভাবকদের গর্ব করার মতো জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলে আমার অন্তত মনে হয়না।
আমাদের এমন ব্যর্থতার পেছনে আমাদের স্কুল জীবনের কয়েকটি ঘটনা কার্যকারণ ও বহুকারনবাদ এর নিয়ম অনুযায়ী পরোক্ষভাবে হলেও দায়ী বলে আমার কখনও কখনও মনে হয়। ফলে আমাদের স্কুল জীবনে ঘটে যাওয়া দু'একটা ঘটনা আমি উল্লেখ করতে চাই।
১। আমরা ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তৎকালীন স্বনামধন্য ও প্রতাপশালী প্রধান শিক্ষক আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। কিন্তু স্যারের ব্যক্তিত্ব এবং স্যারের প্রতি ছাত্রদের সম্মান ও ভয়ের কারণে আমরা অনেকেই স্যারের পড়া করে এসেও স্যারের সামনে পড়া দিতে পারতামনা। ফলে সকলে মিলে স্যারকে আমাদের ক্লাসে না এসে অন্য স্যার দেয়ার আবেদন করি। স্যার কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও তিনি আমাদের অন্য শিক্ষক দেন। এ সুযোগে দু'একজন শিক্ষক এবং অভিভাবক এটাকে প্রধান শিক্ষকের অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন।
২। পরের বছর আমরা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। অল্পদিন যোগদান করা একজন বিএসসি শিক্ষক আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন। তিনি একজন ছাত্রকে পড়া না পারার কারণে কান ধরতে গেলে ছাত্র মাথা কিছুটা সরিয়ে নেয়। তখন ছাত্রের চুল এবং কলির কিছু অংশ স্যারের হাতে পড়ে এবং কয়েকটি চুল স্যারের হাতে উঠে আসে।
এ ঘটনা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করি। আরও দু'এক ক্লাসে এমন হয়েছে মর্মে স্বাক্ষী রেডি করি। নিরুপায় হয়ে নিরীহ স্যার লজ্জ্বায় চাকরি ছেড়ে চলে যান।
৩। অস্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় উল্লেখ করার মতো ঘটনা আজ মনে পড়ছেনা। তবে উল্লেখ করার মতো ঘটনা আমাদের প্রতি বছরই কিছু ঘটেছে।
৪। ১৯৮৫ সাল, আমরা নবম শ্রেণির ছাত্র। তৎকালীন প্রচন্ড ক্ষমতাধর উপজেলা চেয়ারম্যান কোনো এক উপলক্ষে আমাদের বিদ্যালয়ে আসবেন। বিদ্যালয়ে সাজ সাজ রব। কর্মঠ কয়েকজন ছাত্রকে স্কুল ক্যাম্পাস সাজানো এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতে সহায়তা করার জন্য স্কুলে রাতেও রাখার কথা বলা হলো। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করলো ঠিকই, কিন্তু বিনা অনুমতিতে অফিস রুম থেকে পূর্বের পরীক্ষার অনেক খাতা বাজারে বিক্রি করে দেয়। যা ছিল একটা চরম অন্যায়। আমরা সকল ছাত্রছাত্রী স্যারদের নিকট ক্ষমা চাইলাম। স্যাররা ক্ষমা করলেন।
৫। যতটুকু স্মরণ করতে পারি এবছরই আরও দু'একটা ঘটনা ঘটে যা ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়।
কয়েকজন ছাত্রের কিছু খারাপ কর্মকাণ্ড আমাদের একজন প্রভাবশালী শিক্ষকের নজরে আসে। এগুলো নিয়ে স্যারের সাথে কয়েকজনের ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়। একদিন সংঘবদ্ধ হয়ে সাইকেলের চেইন দিয়ে স্যারকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিছু সৌভাগ্যবান ছাত্র এ আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে আহত হন। স্যার শারীরিক ভাবে তেমন আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও তাঁর পোষাক কয়েক জায়গায় ছিড়ে যায়।
পরবর্তীতে এ ঘটনায় বড় আকারে বিচার বসে। কিন্তু স্যার এব্যাপারে বিচার দাবি না করে সকলকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দেয়ার আবেদন করেন। আমরা ছাত্ররা ক্ষমা না চাইতেই স্যার উঠে এসে একে একে সকলকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা করে দেন। বিচার সভা ভেঙ্গে যায়।
৬। উপজেলা ব্যাপী আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হতে যাচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে কিছু বিষয়ে অবিচার হয় এমন অভিযোগে আমাদের শিক্ষকগণ উক্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্ত ক্রীড়ামোদী ছাত্ররা একজোট হয়ে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষকদের অনুমতি না পেয়ে ছাত্ররা শিক্ষকদের বিনা অনুমতিতে স্কুলের প্যাড সংগ্রহ করে প্রধান শিক্ষকের সীলসহ স্বাক্ষর টেম্পারিং করে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ছাত্রদের এহেন কাজের জন্য বিচার সভা বসে। এখানে অধীকাংশ ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ ছিল বিধায় প্রধান শিক্ষক তাঁর সকল ছাত্রছাত্রীদের ক্ষমা করেন।
উল্লেখ করার মতো আরও কয়েকটি ঘটনা থাকলেও আর একটি ঘটনা উল্লেখ করে শেষ করতে চাই।
৭। একজন সিনিয়র শিক্ষক শহরে বাসকরা তাঁর এক শালিকাকে এনে নিজ স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিছুদিন পরেই উক্ত শালিকাকে নিয়ে বেশ কিছু ছাত্র উদ্দেশ্যেমূলক ভাবে কুৎসা রটনা করতে থাকে। এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে সম্মানের সাথে উক্ত ছাত্রীর টিকে থাকা মুস্কিল হয়ে পড়ে। এব্যাপারে দায়ী এমন কয়েকজন ছাত্রকে চিহ্নিত করা গেলেও উক্ত শিক্ষক ছাত্রদের কোনোরকম বিচারের আওতায় না এনে ছাত্রদের ক্ষমা করেন। শুধু আক্ষেপ করে বলেন- আমার ছেলেমেয়েদের কারণে আমার আত্মীয়কে আমার বাড়িতে রাখতে পারলামনা, এটাই আমার দুঃখ। আমার ছেলেমেয়েদের আমাদের মানুষ করতে হবে আগে। তিনি অসহায়ের মতো তাঁর শালিকাকে পাঠিয়ে দেন।
উপরিউক্ত সকল ঘটনায়ই সম্মানিত শিক্ষকগণ তাঁদের ছাত্রদের ক্ষমা করেছেন। তাহলে আমাদের ব্যাচের পরীক্ষার ফলাফল এমন নিকৃষ্টতম হলো কেন! আমরা ৬৬ জন ছাত্রছাত্রী এসসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ০৬ জন পাশ করি, যার মধ্যে চারজন নিয়মিত ছাত্র ছিলাম। যদিও ওইবছর বোর্ডের গড় পাশ ছিল ৪২ শতাংশ। কেনইবা আমাদের ব্যাচের কেউ-ই জীবনে শিক্ষক বা অভিভাবকদের গর্ব করার জায়গায় আমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি! আমাদের জীবনের এ ব্যর্থতার দায় বারবার ক্ষমা করা আমাদের ক্ষমাশীল শিক্ষকদের কতটা তা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকগণ সবসময় ক্ষমা ই করে থাকেন। শিক্ষকগণ কখনোই ছাত্রদের অভিশাপ দেন না, দিতে পারেন না। কিন্তু কীভাবে যেন অভিশাপ লেগে যায়। সীমা লংঘনকারীদের প্রতি প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের ব্যাচ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলে আমি মনে করি।
বর্তমানে আমাদের কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী শিক্ষকদের প্রতি যে আচরণ করছেন, তা দেখে আমি শংকিত। আমি নিশ্চিত - ভিক্টিম শিক্ষকগণও আমাদের শিক্ষকদের মতো সবকিছুই ক্ষমা করে দিবেন। হয়তো তারা অভিশাপও দিবেন না। কিন্তু প্রকৃতি কি ক্ষমা করবে! সেটাই ভয়। কারণ শিক্ষকদের অপদস্ত করা আমাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, আমাদের ভবিষ্যৎ, মেধাবী ছাত্রছাত্রী প্রকৃতির রোষানলে পড়ুন, তা আমাদের কারোই কাম্য নয়।
তাই আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক মন্ডলী, অভিভাবকবৃন্দ এবং প্রশাসকবৃন্দ সকলকেই এব্যাপারে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
মহান সৃষ্টিকর্তা সকলকে ক্ষমা করুন।
# বিঃ দ্রঃ লেখাটি একজন প্রাক্তন ছাত্রের বক্তব্য অবলম্বনে।
What's Your Reaction?