ভাঙ্গায় সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা এক জয়িতার সংগ্রামী জীবনের কথা
পরিবার সমাজের উন্নয়ন,কৃতিত্ব, সংগ্রামী জীবন সহ নানা ক্ষেত্রে নারীর রয়েছে অসামান্য অবদান। প্রতিটি সফলতার গল্পকে যদি পিছনে ফিরে তাকানো যায় দেখা যাবে তাতে রয়েছে কোন নারীর অবদান। তেমনি একজন সফল জননী ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের হিরালদী গ্রামের বেগম সামর্তবান। অত্যন্ত প্রতিকুল এবং দারিদ্র্য পরিবারের মধ্যেও তিনি তার সন্তানদের শিক্ষিত,মার্জিত এবং আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ৯ সন্তানের সফল এ মাতার সন্তানেরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল এবং প্রতিষ্ঠিত। তার পিছনের সংগ্রামের ইতিহাস এবং দারিদ্র্যতার কঠিন মুহূর্তের কথা মনে করে তার এবং সন্তানদের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন সামর্তবান নামে একটি ফাউন্ডেশন। এই নারীর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি৷ স্বরুপ এ বছর নির্বাচিত হয়েছেন জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় তাকে বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি দেওয়ায় তিনি আপ্লুত। তিনি তার কাজকে আরও বেগবান করবেন বলে জানান তিনি। সোমবার বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, ফরিদপুরের আয়োজনে ৫ জন জয়িতাকে এ বছর ফরিদপুর জেলায় নিজ নিজ জায়গায় অসামান্য অবদানের জন্য জয়িতা নির্বাচিত করে তাদেরকে সম্মাননা পদক ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে বেগম সামর্তবানকে জেলার শ্রেষ্ট জয়িতা নির্বাচিত করে। এ উপলক্ষে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় তাকে সম্মানসূচক ক্রেষ্ট, সনদপত্র এবং সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্যা বিশেষ অতিথি হিসেব ছিলেন পুলিশ সুপার মোঃ আব্দুল জলিল, পিপিএম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ ইয়াছিন কবিরের সভাপতিত্বে এতে বিভিন্ন দফতরের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ও সুধী সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক সহ নানা শ্রেণী পেশার লোক উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে একই দিনে ভাঙ্গা উপজেলায় জয়িতা পুরস্কার গ্রহন করেন হাজী সামর্তবানের পক্ষে ছেলে সেঝো ছেলে ওবায়দুর রহমান।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী ক্যাটাগরিতে জয়িতা হিসেবে ভাঙ্গা উপজেলায় ও সমগ্র ফরিদপুর জেলায় এ বছর শ্রেষ্ট নারীর মর্যাদাপ্রাপ্ত জয়িতা এ নারীর জীবনে রয়েছে বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া এবং তার জীবনের হার না মানা গল্প। শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত এ নারী জীবনের স্বপ্ন থেকে প্রতিষ্ঠা করেন হাজী আব্দুল করিম ও সামর্তবান ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। নিজ গুনে গুনাম্বিত এ নারীর জন্ম গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার মুন্সিনারায়ণপুর নামে প্রত্যন্ত গ্রামে এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। পিতা হেলাল উদ্দিন মিয়া এবং মাতা সাবজান খাতুন। ১২ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলো।পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার এবং গোড়ামির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগটুকু হয়নি।অন্যদিকে তৎকালীন সময়ের এক সাধারন রেওয়াজ অনুযায়ী অল্প বয়সে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার হিরালদী গ্রামের এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে হাজী আব্দুল করিম মিয়ার সাথে ধর্মীয় রেওয়াজ অনুযায়ী পারিবারিক ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। স্বামীর সংসার ছিলো মুলত কৃষি কেন্দ্রিক ও বৃহৎ যৌথপরিবার। বেশ কিছু কৃষি জমির মালিক হওয়ায় তা সামলানো অনেক কঠিন কাজ ছিল তার জন্য। এক পর্যায়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে ৯ সন্তানের সফল জননী হন তিনি। পরবর্তীতে শিক্ষার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থেকে ৯ ছেলে মেয়েকে যেভাবেই হোক ভালো মানুষ হিসেব গড়ের তোলা এবং উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এক ধরনের ইস্পাত কঠিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা পেয়ে বসেছিলো তাকে। কিন্ত এক সময় নিজের এক ছেলে সন্তান অল্প বয়সে ইন্তেকাল করায় প্রচন্ডভাবে মানুষিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন তিনি। উপক্রম হয়, পরবতীতে নিজেকে কোনোরকম সামলিয়ে অবশিষ্ট আট সন্তানকে নিয়ে জীবনের লক্ষে পৌঁছানোর স্বপ্ন পূরণের পথে হাটতে থাকেন। কারন তার জীবনের অপুর্ণতাটুকু সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে বদ্ধপরিকর হন তিনি। কিন্তু তখনকার সময়ে অত্র অঞ্চলে বিশেষ করে হিরালদী গ্রামে শিক্ষার আলো মুলত: ছিলো না। এমনকি শিক্ষার মতো ভালো উদ্যোগ কে নিরুৎসাহিত করতে নানা অপচেষ্টাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছিলো। কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হতো। বিশেষ করে মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হতে হয়েছে, তবে ধর্মীয়ভাবে মৌলিক শিক্ষা দিতে সমর্থ হয়েছে।স্বামীর একান্ত আগ্রহ ও প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় এই বন্ধুর পথ টুকু পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে । জীবনের পট পরিক্রমায় কৃষি অর্থনীতি পরিবারের মূল চালিকা শক্তি হওয়ায়, অন্যদিকে পরিবারের নগদ অর্থের যোগান অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারনে। নিজের বাবার একান্ত সহযোগিতায় ও আগ্রহে নিজের দিকে না তাকিয়ে শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যায়। আর্থিক অস্বচ্ছলতার সাথে বিভিন্ন ধরনের গোরামী ও কুসংস্কারের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে ইস্পাত কঠিন লক্ষে অটুট থাকে এবং মহান আল্লাহর রহমতে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে প্রত্যাশা পূরনে কিছুটা হলে ও সক্ষম হয়। আজ তার আট ছেলে মেয়ে ও তাদের ছেলেমেয়েরা বেশ প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে নজরুল ইসলাম, স্নাতক, নিজে, বউমা, ২ নাতি- নাতনি সহ মোট চার জন আজ আমেরিকায় প্রতিষ্ঠি। মেঝো ছেলে মো: শহীদুল ইসলাম, হিরালদী গ্রামে এসএসসিতে মানবিকে প্রথম স্টার মার্কপ্রাপ্ত, স্নাতকোত্তর, সরকারী চাকরীজীবি, বউমা স্নাতক,সেঝো ছেলে ওবায়দুর রহমাদ এমএসসি সরকারী চাকুজীবি এবং সর্ব কনিষ্ঠ ছেলে মো: রফিকুল ইসলাম বিকম সম্মান ও এমবিএস (এ্যাকাউন্টিং), ব্যাংকার, বউমা বিকম সম্মানও এমকম (ব্যবস্থাপনা), ব্যাংকার।
এবং মেয়েদের ছেলেমেয়েরা ও আজ উচ্চ শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত।
নিজের পরিবারের সদস্যদের ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করে বিগত কয়েক বছর ধরে আনুষ্ঠানিক ভাবে সমাজ উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন তিনি। সমাজে দরিদ্র ও মেধাবীদের মেধাসম্পদে বিকশিত করার জন্য ইতিবাচকভাবে উৎসাহিত করতে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে বিশেষ করে গ্রামের খুব সাধারন মহিলাদের গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা, টেঁকসই ভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ শুরু করেন।এজন্য পারিবারিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় হাজী আব্দুল করিম ও সামর্তবান ফাউন্ডেশন নামক এক অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। তাদের জীবনের সামাজিক ও মানবিক কাজ গুলি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি পরিকল্পিতভাবে পাঁচটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে তার স্বামীর জীবনের অসমাপ্ত কাজ ও নিজের জীবনের অপূর্ণতা পূরনের জন্য সরাসরি সামনে থেকে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরন, সবার জন্য খাদ্য প্রদান,গরীব ও মেধাবীদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি প্রদান। ইতিমধ্যে প্রকল্পের আওতায় সমগ্র ভাংগা উপজেলায় ৪০ জন এসএসসি ও দাখিল ২০২৪ এ উত্তীর্ণদের মাঝে জনপ্রতি ৩০০০/- টাকার প্রাইজবন্ড, সনদপত্র, ক্রেষ্ট বিতরন করা হয়েছে। এছাড়া স্বাবলম্বী ও আত্বকর্মসংস্থান প্রকল্প। যার মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক অতি দারিদ্র্তা দূরীকরনের জন্য ও প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য ইতোমধ্যেই ৬৩ জন মহিলা কে সেলাইমেশিন বিতরণ করা হয়েছে এবং ৪ টি অটোভ্যান বিতরন করা হয়েছে, যা গ্রামীন অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া অন্যান্য প্রকল্পও চলমান রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে শীতার্তদের জন্য কম্বল বিতরন, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, গ্রামের পথচারীদের জন্য ল্যাম্পপোষ্ট স্থাপন , বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য সোডিয়াম লাইট, কার্পেটসহ অন্যান্য উপকরন বিতরণ , প্রকৃত সুবিধাভোগীর মাঝে নগদ অর্থ প্রদান উল্লেখযোগ্য।
What's Your Reaction?