শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান : আলোর পথের একজন দিশারি
রবিবার (১৯ জানুয়ারি) মরহুম রাষ্ট্রপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন পালিত হয়েছে দেশব্যাপী। মহান রবের দরবারে তাঁর রূহের মাগফিরাত প্রার্থনা করছি। রহমানুর রহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে শহীদি মর্যাদা দান করুন এবং জান্নাত নসীব করুন। দেশের জন্য তাঁর খেদমতটুকুন কবুল করুন। আমীন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বেঁচে আছেন জনমানুষের হ্রদয়ে- ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়। বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে। বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের এ জাতি যখনই আশাহত হয়েছে, যখনই পথ হারাচ্ছিল, যখনই অন্ধকার অমানিশার গভীর অতলে ডুবে যেতে বসেছিলো তখনই জিয়াউর রহমান আবির্ভূত হয়েছিলেন উদ্ধারকারি হিসেবে এবং আলোর পথের দিশারি হিসেবে। অসীম সাহসের মানব জিয়াউর রহমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ জাতির উদ্ধারকার্যে এগিয়ে এসেছিলেন বারবার। পাকিস্তানের হানাদারদের আক্রমণের মুখে রাজনৈতিক নেতারা যখন গা-ঢাকা দিয়েছিলো এবং আত্মসমর্পণ করেছিলো, তখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিশেহারা জনগণ ও নেতাকর্মীদের আলো দেখিয়েছেন ; পথরেখা দেখিয়েছেন স্বপ্নের স্বাধীনতার। স্বাধীনতার পর যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার দ্বন্ধ, দুর্ভিক্ষ, লুটপাট, হাহাকার, নির্যাতন -নিপীড়ন, গণতন্ত্রহীনতা, বাকশাল ইত্যাদি সদম্ভে কায়েম করে একটি সদ্য স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার স্বাদকে বিষিয়ে তুলেছিলো, পুরো জাতি যখন ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলো তখনই আবার জাতির ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমান এ জাতিকে পথনির্দেশ করেছেন, যখনই এ জাতি পথ হারিয়েছে। একাত্তরে নেতারা সবাই যখন ভারতে পালিয়ে গেলেন তখন দেশের ভেতরে থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। দিকহারানো বিভ্রান্ত জনগণকে স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ করলেন। নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা যখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে জুলুম এবং লুটপাটের রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো, ক্ষোভে-দু:খে জাতি যখন গুমরে গুমরে কাঁদছিলো তখনই আশাহত-নিরাশ এ জাতিকে আবার আলোর পথ দেখিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এ জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার স্বপ্নের স্বাধীনতার স্বাদ। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার মুখের হাসি। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাক্স্বাধীনতা- কথা বলার অধিকার। প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গণতন্ত্র-বহুদলীয় গণতন্ত্র। প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জনগণের সরকার। দূর করেছিলেন দুর্ভিক্ষ-হাহাকার-লুটপাট। প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সবুজ বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন একটি মর্যাদাবান, শিক্ষিত ও সুগঠিত জাতি বিনির্মানে। এ লক্ষে গ্রহণ করেছিলেন বহুমুখী কর্মসূচি।
জ্ঞানী-গুণী মানুষ ছিলেন না। উনার মনটা ছিল বড় ; খুব বেশি বড়। মানুষকে ভালোবাসতেন প্রচণ্ড। নিজের দেশটাকে ভালোবাসতেন বড্ড বেশি। কথিত আছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের মতো অত্ত সৎ ও দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা দ্বিতীয়জন অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। আরও কথিত আছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন ইতিহাসে জিয়াউর রহমানই ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং পারদর্শী।
ঊনিশ শ একাত্তর সালে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর বড়মাপের কোন কর্মকর্তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্রেফ মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তা। কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যে মাফেরই ছিলেন না কেন, তাঁর মনটা ছিল প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক। তাঁর মনটা ছিল প্রচণ্ড সাহসী। জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্বাধীনতার ঘোষণার মতো সাহসী ঘোষণা দিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, কুল-কিনারা হারানো জনতার মধ্যে ফিরে আনেন হারানো সন্বিৎ। তাঁর ঘোষণাতেই জাতি পায় চলার পথের দিশা, দ্বিধাগ্রস্ত অক্ষম রাজনীতিবিদরা ফিরে পায় তাদের হারানো সন্বিৎ । এক সাগর রক্তের বিনিময়ে নয় মাস যুদ্ধের পর জাতি পায় স্বপ্নের স্বাধীনতা।
একাত্তরের অদম্য সাহসী অকুতোভয় বীর সৈনিক জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্যদিয়ে পথহারা জাতির কাণ্ডারী ও ত্রানকর্তা হিসেবে দেশের ভাগ্যাকাশে উদিত হন জিয়াউর রহমান। তিনি কখনো দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চাননি। এম পি কিংবা মন্ত্রী হতে চাননি। রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি কখনো মাথাও ঘামাননি। রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে ক্ষমতালোভীদের ছিনিমিনি খেলা দেখে ত্যক্তবিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে দেশপ্রেমিক সিপাহি জনতা তাঁকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এ দেশের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই হয়েছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ ও নিরহংকারী প্রেসিডেন্ট। তাঁর পরিবারের কাউকে তিনি এম পি কিংবা মন্ত্রী বানান নাই।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয় মাত্র পাঁচ বছর। পাঁচ বছরে তিনি দেশ থেকে অভাব-অনটন দূর করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশে পরিণত করেন। দারিদ্র্য দূর করেন এবং দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেন। দেশ থেকে খুনোখুনি নির্মূল করেন। দেশ থেকে লুটপাট ও জুলুম নির্যাতন দূর করেন। মানুষের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগ, জাসদ, বিএনপি, জামায়াতসহ সবার রাজনীতি করার অধিকার নিশ্চিত করেন। মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। মুক্তিকামী জনতার মধ্যে বইয়ে দেন স্বাধীনতার সুখ। মানুষ খুঁজে দেন সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা।
পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তাঁর প্রণীত ঊনিশ দফা কর্মসূচি সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, বাম ও ডান ঘরানার বহু রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী ও পেশাজীবি তাঁর গঠিত রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন। সবাইকে নিয়ে তিনি দেশগঠনে মনোনিবেশ করেন এবং অভূতপূর্ব সফলতাও লাভ করেন। সময়ের পরিক্রমায় বিএনপি আজ দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ও নন্দিত রাজনৈতিক দল। দেশ গঠনে তাঁর এ সফলতার মূলে ছিলো তাঁর ব্যক্তিগত সততা ও দেশপ্রেম। তাঁর এ সফলতার মূলে ছিলো, তাঁর সাথে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে তিনি সততা ও দেশপ্রেমের বীজ বপন করতে পেরেছিলেন। তাঁর এ সফলতার মূলে ছিলো, তিনি সাধারণ মানুষের কথা শুনতেন মনোযোগ দিয়ে পাশাপাশি বিজ্ঞজনের কথাও শুনতেন মনোযোগ দিয়ে ; এক কথায় তিনি সবার কথা শুনতেন। তাঁর এ সফলতার মূলে ছিলো, তিনি কাউকে অমর্যাদা করতেন না - কাউকে অসম্মান করতেন না। তাঁর এ সফলতার মূলে ছিলো, তিনি দেশের শহরে গ্রামে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন ; শহর ও গ্রামের সমস্যা নিজ চোখে দেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং ওসব সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা করেছেন। তাঁর এ সফলতার মূলে ছিলো, তাঁর কর্মে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো। তাঁর মধ্যে ছিলোনা অর্থ-বিত্তের লোভ-লালসা কিংবা ক্ষমতালিপ্সা। কেবলমাত্র ছিলো সততা আর সততা - দেশপ্রেম আর দেশপ্রেম। শুধু ছিলোনা অহমিকা এবং ঔদ্ধত্য। কথায় ও কাজে ছিলো প্রচণ্ড মিল তাঁর। ওয়াদা রক্ষায় ছিলেন আন্তরিক, কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করতেন না, ছিলেন দৃঢ় চেতা ব্যক্তিত্বের অধিকারি। যার ফলে মাত্র পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করে তিনি হয়েছেন জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক এবং একটি জননন্দিত রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। যখনই জাতি পথ হারিয়েছে তখনই তাঁর গড়া দল বিএনপি জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে, শেখ মুজিবুর রহমানের কথাও একটু বলে নিই। তাহলে স্বল্প পরিসরে শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে মূল্যায়ন করতে পারবেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সেই থেকে ৭১ পর্যন্ত ২৩ বছর ধরে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে যত্ত আশা আকাঙ্ক্ষার কথা ও স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন ৭২ সালে ক্ষমতায় এসে নিজের হাতেই জাতিকে দেখানো সেসব আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিষ্ঠুরভাবে নিমেষেই হত্যা করে বসেন। উনার কাছে ক্ষমতাই ছিলো মুখ্য বিষয়। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করাই ছিলো উনার সকল কর্মকাণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্য। জাতির সাথে করা অঙ্গীকারের মূল্য কখনো উনার কাছে ছিলোনা। অঙ্গীকার ভঙ্গের নিষ্ঠুরতম পরিণতি উনাকে বরণ করতে হয়েছিলো নির্মমভাবে। উনার রাজনৈতিক ও পারিবারিক উত্তরাধিকারিরা সেসব পরিণতি থেকে এবং তার করা কর্মকাণ্ড থেকে কখনো
শিক্ষা গ্রহণ করেনি। উপরন্তু, দম্ভভরে এবং জাতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উনার মতোই অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন। যার করুন পরিণতি বরণ করে উনার দানব কন্যা হাসিনা জনমানুষের রোষানলে পড়ে সেনা কর্মকর্তাদের দয়ার বদৌলতে দেশ থেকে পালাতে পেরেছেন। দানব হাসিনার এ পলায়ন থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটা পাঠ নিজেদের সামনে রাখবে বলে আমি আশা করি।
অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতালোভী সেনা কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে শহীদি মর্যাদা দান করুন। আমীন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলে রেখে যান। মৃত্যুকালে রেখে যাননি বাড়ি গাড়ি, অঢেল সম্পদ কিংবা ব্যাংক ব্যালেন্স। অর্থ-বিত্তহীন পরিবার রেখে তিনি পরপারে পাড়ি জমান। লোভ-লালসাহীন উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের এক আদর্শ রেখে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। লুটপাটবিহীন ও চোরমুক্ত একটি রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তব নমুনা রেখে তিনি পরপারে পাড়ি জমান। রেখে যান জনমানুষের আস্থার ঠিকানা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপিকে অবশ্যই জিয়াউর রহমানের জীবন পাঠ করতে হবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের জিয়াউর রহমানের জীবন বুঝতে হবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের জিয়াউর রহমানের জীবন অনুশীলন করতে হবে। নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে, বিএনপি এদেশের মানুষের ভালোবাসার দল, মানুষ এখানে এসে সুখের কথা বলে, মানুষ এখানে এসে দু:খের কথা বলে। নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে, বিএনপি ভাগাভাগির কথা বলেনা-বিভাজনের কথা বলেনা। নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে, লুটপাটকারি, চোরাচালানি এবং সন্ত্রাসীদের বিএনপি আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়না। নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে, নারীলোভী, অর্থলোভী ও নেশাখোরদের ঠাই বিএনপিতে নেই। নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে, আল্টিমেটলি, বিএনপি ভদ্রলোকদের দল। এটা না বুঝতে পারলে দীর্ঘশ্বাসই ফেলতে হবে।
What's Your Reaction?