গুজব এবং ভাইরালকাণ্ড

জাহিদুর রহমান
Jun 22, 2024 - 14:11
 0  66
গুজব এবং ভাইরালকাণ্ড
গুজব এবং ভাইরালকাণ্ড

বছর পনেরো আগে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ - এনায়েত আলীর ছাগল নামে একটি নাটক নির্মাণ করেছিলেন। গুজব থেকে কীভাবে জনসমর্থনকে নিজের পক্ষে আনা যায়, কীভাবে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে লাভবান হওয়া যায় সেই বিষয়টি এ নাটকে তিনি তুলে ধরেছিলেন। এ নাটকের গল্প তৈরি হয় একটি ছাগলকে কেন্দ্র করে, যেই ছাগল কিনা মানুষের মতো কথা বলে।

শুরু হয় ছাগলকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ। দুর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে কথা বলা ছাগল দেখতে, ছাগলের পশম নিয়ে গলায় বাধতে এমনকি রোগ নিরাময়ের পথ্য হিসেবে  ছাগলের লাদি সংগ্রহ করতে।  ছাগল ঘিরে মানুষের আগ্রহের সীমা সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে যখন বুম হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে হাজির হন নামকরা সাংবাদিকবৃন্দ। এনায়েত সাহেবের বাড়িতে মানুষ আর মানুষ। 
এক পর্যায়ে নিসন্তান এনায়েত আলী জানতে পারেন তাঁর স্ত্রী সন্তান লাভের আশায় ছাগলের লাদি ভক্ষণ করার জন্য লাদি সংগ্রহ করেছেন। ছাগলটির প্রদর্শন ও সংবর্ধনা দেয়ার জন্য এক মেলার আয়োজন করা হয় এবং নিউজের কাটতি শেষে সাংবাদিকের পরামর্শে ছাগলটিকে মেরে ফেলা হয়।
ছোট্ট একটি গল্পকে কেন্দ্র করে, অদূর ভবিষ্যতের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র এই নাটকে তুলে ধরেন দূরদর্শী চিন্তাধারার লেখক ও নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। 
এই নাটকের শিক্ষণীয় ও বিখ্যাত ডায়ালগ ছিল- ছাগল মানুষের মত কথা বলেনা, কিছু মানুষ ছাগলের মত কথা বলে। সমাজের আঁনাচে কাঁনাচে অবস্থান করা সুযোগ সন্ধানী মানুষের চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। ইস্যু ও ভাইরাল পাগল বাঙালির চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে কিভাবে ব্যক্তি স্বার্থে সেটা ব্যবহার করা যায় সেটি  সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের মানুষের গুজব রটানোর দক্ষতা কতটা ভয়াবহ, কতটা দক্ষ, কতটা শক্তিশালী সেটা হুমায়ুন আহমেদ হাস্যোরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এই নাটকে। হুজুগে বাঙ্গালী স্বভাব কথাটার যথার্থতা এই নাটকের মাধ্যমে তিনি
শতভাগ প্রমাণ করেছেন।
হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন- স্বার্থন্বেষী মহল গুজব বহন করে, মুর্খরা ছড়ায় এবং বোকারা সেটি গ্রহণ করে। 

কয়েকবছর আগেই পার্শ্ববর্তী নগরকান্দা উপজেলার ছাগলদী গ্রামে ফটিক চান নামের পাঁচ বা সাত বছর বয়সী বালকের পানি পড়া সংগ্রহে বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ সে গ্রামের জলাশয়গুলো শুকিয়ে ফেলেছিল। একশো বা দু'শ মিটার দুর থেকে এমনকি ঘরের চালায় বসে বালক ফটিকের ফুঁ দেয়া দুষিত এক বোতল পানি সংগ্রহ করার জন্য শহর থেকে আসা শত শত গাড়ির ভীড় পড়ে যেতো। 
সম্প্রতি রাঘদী ইউনিয়নের গর্জিনা গ্রামে একটি গাছ নাকি মানুষের মতো কথা বলছে! সেখানেও যথারীতি আগ্রহী, অনুসন্ধিৎসু মানুষ এবং বুম হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে বিখ্যাত সব সাংবাদিকদের আগমন ঘটেছে। 
এনায়েত আলীর ছাগল মারা গিয়েছিল, ফটিক চানের পানি পড়া খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে রাঘদীর গাছের কথা বলার ভাষা কতদিন থাকবে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।  
কিছু মানুষ ফেসবুকে যত উদ্ভট কাজ করছে, আমরা সেটা নিয়ে মাতামাতি করে রাতারাতি সেই মানুষকে  ভাইরাল করে তাদের সেলিব্রেটি বানিয়ে দিচ্ছি। অনেকে অনেকসময়  অত্যন্ত সুকৌশলে, জেনে বুঝে ছাগলের মত কথা বলেন এবং পাগলের মত কাজ করেন। তারপর আমরাও অনেকে ট্রোল করতে করতে  তাকে বিখ্যাত বানিয়ে দেই। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশই থাকে গুজব, ভিত্তিহীন এবং যুক্তিযুক্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিহীন।

তবে পনেরো লক্ষ টাকায় কেনা ইফাত সাহেবের কোরবানির ছাগল যে ইদানিং ভাইরাল হয়েছে, সেটা কিন্তু মোটেই এনায়েত আলীর ছাগলের মতো ভূঁয়া নয়। এটা সত্য বলেই মনে হচ্ছে। ইফাত সাহেবের ছাগলকান্ড বরং তার পিতা রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ড. মতিউর সাহেবের অনেক সত্য সামনে নিয়ে আসছে, সন্ধান দিচ্ছে তাঁর প্রাপ্ত আলাদিনের চেরাগের। যদিও আলোচিত ইফাত পিতৃ পরিচয় হারানোর শংকায় আছেন। 

যে ভাইরাল কান্ড লুক্বায়িত সত্যকে, অনিয়ম ও দুর্নীতিকে সামনে নিয়ে আসে; সে ভাইরাল কান্ড অবশ্যই আমাদের হুজুগে বাংগালী অপবাদ দিবেনা। ইদানিং আরও অনেকের থলের বেড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। হয়তো হাজারো মতিউর তৈরি হয়েছে এইদেশে। এঁদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে দেশের সামনে অপেক্ষা করছে ঘোর অমানিশা। 
তাই সকল সচেতন ব্যক্তির উচিত নিজেদের আশপাশের ইফাত, মতিউর, বে-নজীরদের আলাদীনের চেরাগের তথ্য ভাইরাল করে দেয়া। যদি  আমরা তা করতে পারি, তবেই দেশের মঙ্গল।  

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow