চট্টগ্রামের আলোচিত মিতু হত্যা মামলাঃ ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করার অভিযোগ সাক্ষীদের
পরকীয়ার জের ধরে বাবুল আক্তার স্ত্রী মিতুর টাকায় মিতুকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করিয়েছে বলে আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন মিতুর মা শাহেদা মোশাররফ। মাহমুদা খানম মিতু খুনের মামলায় গতকাল চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি এ কথা জানিয়েছেন। মিতুর মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। শাহিদার পাশাপাশি গতকাল সাক্ষ্য দিয়েছেন পাঁচলাইশ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাহমুদ। এ নিয়ে ৪৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য রেকর্ড করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কেশব নাথ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, দুই সাক্ষীর মধ্যে একজনের পূর্ণাঙ্গ জেরাও সম্পন্ন হয়েছে। অপরজন শাহিদার আংশিক জেরা হয়েছে।আজকে বাকি জেরা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
পাঁচলাইশ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মাহমুদ আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেন, আমি পাঁচলাইশ থানায় কর্মরত থাকাকালে ২০১৬ সালের ৬ জুন তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের টাইপ করা অভিযোগ পেয়ে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড করি। বাবুল আক্তার নিজে হাজির ছিলেন না। তার কোনো স্বজনও তখন থানায় হাজির ছিলেন না। তিনি বলেন, ঘটনার সাথে সাথে প্রথমে আমার একটি টিম ঘটনাস্থলে যায়। এর পরপর আমিও সেখানে গিয়ে পৌঁছাই।
মিতুর মা শাহিদা মোশাররফ সাক্ষ্যে বলেন, ভিকটিম আমার মেয়ে এবং বাবুল আক্তারের স্ত্রী ছিল। বিয়ের পর তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। পরে এডিশনাল এসপি হিসেবে কঙবাজারে থাকাকালে গায়ত্রী অমর সিং নামে এক বিদেশি মহিলার সাথে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে বাবুল আক্তার। একদিন বাবুল আক্তার আমার মেয়ে মিতুকে নিয়ে কঙবাজারে একটি হোটেলে ওঠে। একই হোটেলে গায়ত্রী অমর সিংও ওঠে। গায়ত্রীর রুমে বাবুল ও গায়ত্রী আপত্তিকরভাবে পাশাপাশি বসে কম্পিউটারে কাজ করার সময় মিতু তাদের দেখে। মিতুর তাতে খুব খারাপ লাগে। কী করছে জানতে চাইলে বাবুল আক্তার জানায়, সে বিদেশে যাওয়ার জন্য ল্যাপটপে কাজ করছে। মিতু কিছুক্ষণ সেখানে থেকে নিজের রুমে বাচ্চাদের কাছে ফিরে যায়।
শাহিদা বলেন, রাত ৩টায় মিতুর ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে, বাবুল আক্তার রুমে নেই। তখন সে গায়ত্রীর রুমে যায়। গিয়ে দেখে বাবুল বাবুল ও গায়ত্রী আপত্তিকর অবস্থায় আছে। মিতু তখন তার রুমে ফিরে এসে আমাকে ফোন দেয়। আমি তাকে বলি, বাবুল আক্তারের কাছ থেকে তুই চলে আয়। মিতু জানায়, মাহির ও টাপুর তাকে খারাপ ভাববে, তাই সে চলে যাবে না। বলে আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকবে। দেখা যাক কী হয়।
পরে বাবুল আক্তার চট্টমেট্রোতে বদলি হয় উল্লেখ করে শাহিদা বলেন, চট্টগ্রামের বাসায় দুজন আলাদা রুমে থাকত। বাবুল আক্তার গভীর রাত পর্যন্ত অনেক মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলত। মিতু আড়ি পেতে এসব শুনত। বাবুল ২০১৪ সালে মিশনে যায়। বাবুল আক্তার তার একটি মোবাইল বাসায় রেখে যায়। ওই মোবাইলে মিতু বাবুল আক্তারের কাছে গায়ত্রীর পাঠানো ২৯টি মেসেজ পায়। এছাড়া গায়ত্রীর উপহার দেওয়া দুটি বই পাওয়া যায়। মিতু ওই মেসেজগুলো দুটি বড় ও দুটি ছোট পৃষ্ঠায় লিখে রাখে। পরে সে আমাদের এসব জানায়। আমাদের জানানোর বিষয়টি বাবুল আক্তার জানতে পেরে মিতুর উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। মিতু তিন–চারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। একবার চট্টগ্রামের বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
সাক্ষ্যে শাহিদা আরো বলেন, ২০১৬ সালের ৪ জুন মিতু আমাকে ফোন দেয়। মাহিরের স্কুল থেকে মেসেজ আসায় খুব ভোরে মাহিরকে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে। ৫ তারিখ সকালে মিতুর বাসার পাশের ফ্ল্যাটের একজন মহিলা আমার নম্বরে কল দিয়ে বলে, মিতু ভাবি গ্যাসের সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে এঙিডেন্ট করছে। আমি মিতুকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে বলি এবং যত টাকা লাগে আমি নিয়ে আসব বলি। এরপরই মাহির ফোন করে বলে, তার মাকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়েছে ও গুলি করেছে। আমি মাহিরকে জিজ্ঞাসা করি, তার মা কথা বলে কিনা। তখন মাহির বলে, তার মা কথা বলে না। তাকিয়ে আছে। তার বাবাকে ফোন করেছে কিনা জানতে চাইলে মাহির বলে, করেছি, কিন্তু কথা বলে না। পরে আমরা চট্টগ্রামে আসি এবং ঘটনাস্থলে যাই। পরে বাসাতেও যাই। পরে পুলিশ লাইন্সে মিতুর জানাজা হয়। এরপর জানতে পারি, মিতুর উপর আক্রমণের পর মাহির বাবুল আক্তারকে তিনবার ফোন করে। কিন্তু সে রিসিভ করেও কথা বলেনি। আমি নিজেও তাকে একবার কল দিই। কিন্তু বাবুল আক্তার কল ধরেনি।
শাহিদা বলেন, বিদেশে থাকাকালে বাবুল তিন–চারবার দেশে আসলেও স্ত্রী সন্তানদের কাছে আসে নাই। মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং মিশন থেকে এসে চায়নাতে ট্রেনিংয়ে যায় বাবুল আক্তার। সেখানে বসেও মিতু হত্যার পরিকল্পনা করে সে। মিতুর একটা ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসার তিন লাখ টাকা দিয়েই মিতুকে খুন করিয়েছে। মিতুর মৃত্যুর পর বাবুল আক্তার আমাদের বাসায় ৬ মাস ছিল। সেখানে থেকেই সে আসামিদের সাথে যোগাযোগ করেছে। একপর্যায়ে ২৪ জুন বাবুলকে ঢাকার ডিবি পুলিশ নিয়ে যায়।
আদালত সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএনএইচসিআরের এক কর্মীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে স্ত্রী মিতুকে খুন করিয়েছেন সাবেক এসপি বাবুল আক্তার নিজে–এমন উল্লেখ করে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর বাবুল আক্তারসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ২০৮৪ পৃষ্ঠার ডকেট ও ২০ পৃষ্ঠার চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুক। বাবুল ছাড়া চার্জশিটভুক্ত বাকি ৬ জন হলেন মোতালেব মিয়া প্রকাশ ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, এহতেশামুল হক ভোলা, শাহজাহান মিয়া, কামরুল ইসলাম মুসা ও মো. খায়রুল ইসলাম কালু। ২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নগরীর ও আর নিজাম রোড এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মিতু। ঘটনার পর বাবুল আক্তার যে মামলা করেছিলেন সেটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হলে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। পরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাবুলসহ সাতজনের বিরুদ্ধে নতুন করে একটি মামলা দায়ের করেন।
What's Your Reaction?