ছাত্র-শিক্ষক ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট :

জাহিদ রহমান
Aug 30, 2024 - 20:08
 0  19
ছাত্র-শিক্ষক ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট :

প্রায় বিশ বছর আগের কথা। তখন কগনিজেন্স আদালত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ পরিচালনা করতেন। পরিচিত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যাই। অনেকদিন একসাথে চলেছি, অনেক স্মৃতি রয়েছে। তাই অনেকটা সময় গল্প করে অতিবাহিত করি। গল্প করতে গিয়ে তিনি দর্শন শাস্ত্রের একজন শিক্ষকের সাথে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলেন।

উক্ত শিক্ষক একটি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বিশ বছরের মতো শিক্ষকতা করছেন। ৪-৫ বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর বাম চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে প্রায় ৬০% ডিজ-অর্ডার। 
ওই বছর অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার হলে তিনি কর্তব্যরত ছিলেন। একজন ছাত্র অসদুপায় অবলম্বন করায় উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির খাতা ৩০ মিনিট সাসপেন্ড করেন। ফলে ছাত্রের পরীক্ষা স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ হয়। পরীক্ষা শেষে ওই শিক্ষক ছাত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং বাকী চোখেও আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
হাসপাতালে থাকা অবস্থায় পুলিশ তার বক্তব্য নিতে গেলে তিনি জানতে পারেন এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে এবং ওই ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে। তিনি গ্রেফতারকৃত ছাত্রকে ছেড়ে দিয়ে তাকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেবার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের বিনয়ের সাথে অনুরোধ করেন। সেসাথে উকিলদের মাধ্যমে একই আবেদন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরও পাঠান।
কিন্তু ছাত্রকে পুলিশ এবং আমার পরিচিত ম্যাজিস্ট্রেট কেউ-ই ছাড়েননি। ফলে ওই ছাত্র হাজতে থেকে যায় আর শিক্ষক হাসপাতালে। শিক্ষক যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেন, তখন শিক্ষকের ডান চোখও ৪০% ডিজ- অর্ডার। তারপরও তিনি কাজে যোগ দিয়ে ওই ছাত্রের সর্বশেষ অবস্থার খোঁজ নেন, ছাত্র তখনও হাজতে, বিচার চলমান।  ভিক্টিম হিসেবে শিক্ষকের স্বাক্ষী দিতে হবে।
শিক্ষকের ঘুম নেই। তিনি ছাত্রকে ক্ষমা করতে চান। উকিলদের সাথে কথা বলেও কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।  নিরুপায় হয়ে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথে দেখা করে ছাত্রকে ক্ষমা করার কথা বলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ডিসি মহোদয়ের রুমে নিয়ে যান। সব শুনে ডিসি মহোদয় বলেন - আপনার মতো শিক্ষককে আগে জেলে দেয়া উচিত। এমন অপরাধী ছাত্রকে ক্ষমা করার জন্য অন্যায়ভাবে বিচারকের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন! আপনাদের এমন ক্ষমা অপরাধীদের উৎসাহিত করবে।
ডিসি মহোদয়ের এমন মূর্তি দেখে দু'চোখ ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক অপ্রস্তুত হয়ে যান। তারপরও বলেন- আপনারা বিচারক, বিচার করাই আপনাদের কাজ। আমরা শিক্ষক। ছাত্রদের শিক্ষা দেয়া, ভুল পথ থেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা, ভুল করলে ক্ষমা করা এগুলোই আমাদের কাজ।
একথা শুনে অশ্রুসজল ডিসি মহোদয় চেয়ার থেকে উঠে শিক্ষককে জড়িয়ে ধরেন। ম্যাজিস্ট্রেটকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন।
পরিচিত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আরও বলেছিলেন - অপরাধী ছাত্রপক্ষ তাকে কোনোভাবে ম্যানেজ করেছে কিনা তা বুঝার জন্য ডিসি মহোদয় শিক্ষকের প্রতি কঠিন কথা বলেছিলেন। 
শিক্ষকদের চিন্তাভাবনা, আদর্শ এবং ত্যাগ এমনই হওয়া উচিত। জানিনা শিক্ষকদের এমন ক্ষমা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধীদের উৎসাহিত করে কি-না! 

সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীদের হাতে শিক্ষকদের অপদস্ত করা ও পদত্যাগ করানোর বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষক, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ এসব ঘটনায় আশংকা প্রকাশ করেছেন। মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমন্বয়করাও এধরণের কর্মকাণ্ড থেকে ছাত্রছাত্রীদের বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। 
আবার অনেকেই বলতে চেষ্টা করছেন যে প্রকৃত শিক্ষক কখনও অপদস্ত হয়না। কথাটি হয়তো ঠিক, কিন্তু একটা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সর্বক্ষেত্রে ঠিক তা জোর দিয়ে বলা যায়না। এদের মধ্যে সম্মানিত শিক্ষকদের সংখ্যাও কম নয়। নিজ নিজ প্রধানের উপরে যতো অসন্তোষ, ক্ষোভ এতদিনে জমে আছে তা এ সুযোগে মিটিয়ে নিতে চাচ্ছেন। অনেক শিক্ষক সকল প্রধানদের বিদায় করে নিজেদের  প্রকৃত ও আদর্শ শিক্ষক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। 
উপরে যে শিক্ষকের কথা উল্লেখ করেছি তিনি শিক্ষক হিসেবে কতটুকু "প্রকৃত শিক্ষক" তা নিজ নিজ বিবেচনার উপর নির্ভর করবে। সকল যুগেই কমবেশি এধরণের ঘটনা আছে। 
কিন্তু এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। 

শিক্ষা সেক্টরের সকল পর্যায়েই একটা স্থবিরতা রয়েছে। সঠিকপথে শিক্ষার চাকা ঘোরাতেই হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। 

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow