নতুন কারিকুলামে এক বছর
গতবছর নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন চলাকালীন নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। এ কারিকুলাম সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিলনা। তখন অনেক অভিভাবককে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখেছি, এমনকি অনেক শিক্ষকদেরও। গেল গেল, লেখাপড়া এবার বুঝি শেষ হয়ে গেল - এমনটাই যেন অনেকের ধারণা।
নিজ পুত্র নতুন কারিকুলামের আওতাভুক্ত থাকায় ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রম দেখে একজন অভিভাবক হিসেবে আমি অভিভূত ছিলাম। আমার সন্তান ও তার সহপাঠীদের, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই লেভেলের শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছিলো।
আমি লিখেছিলাম - এ বয়সে, এই লেভেলের শিক্ষার্থীরা এসাইনমেন্ট প্রণয়ন, প্রেজেন্টেশন, নিজ প্রতিভার উপস্থাপন, পোস্টার তৈরি, জোড়ায় কাজ, দলীয় কাজ, আউট ফিল্ড এক্সপেরিমেন্ট, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, টিম লিডার হিসেবে লিডারশীপ কোয়ালিটি প্রদর্শন, বোর্ডে পাঠ উপস্থাপন, সৃষ্টিশীল বিভিন্ন রুচিসম্মত উপস্থাপন - যাকে বলে- হোয়াট নট?
কি নেই এখানে?
এই 'হোয়াইট নট' শব্দ ব্যবহার করায় অনেক শিক্ষক এবং অভিভাবক তীর্যক কমেন্ট করে আমার নাট-বল্টু খুলে নেয়ার উপক্রম করেছিলেন । অধিকাংশ মন্তব্যই ছিল নেতিবাচক।
আমি লিখেছিলাম-সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে মুখস্থ বিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনার যে চেষ্টা হয়েছিল, আমি মনে করি নতুন এ পদ্ধতির মাধ্যমে সেটা কার্যকরভাবে সফল হওয়া সম্ভব। শিক্ষার্থীদের যে কার্যক্রম দেখছি, এগুলোই তো প্রকৃত সৃজনশীলতা।
আমার কাছে মনে হয়েছে পরীক্ষা ভীতি থেকে বের হয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা যেন রীতিমতো উৎসবে মেতেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যায়ন পরীক্ষাকে "সামষ্টিক মূল্যায়ন উৎসব" হিসেবে অভিহিত করছে। অথচ ছাত্রজীবনের এক ভীতিকর অধ্যায় ছিলো পরীক্ষা। এ পরিবর্তন আমার কাছে সত্যিই স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল।
এরপর একবছর পেরিয়ে গেছে, আরও একটি সামষ্টিক মূল্যায়ন সামনে। কিন্তু এই একবছর পরেও ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবক যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের ধারণা আগের মতোই আছে ; এমনকি অনেকের ধারণা আরও বিরুপ এবং আরও নেতিবাচক মনে হয়েছে।
মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এক প্রকার চোর - পুলিশ খেলা চলছে। মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবক সকলেই যেন একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। এই কারিকুলাম নিয়ে একজন অভিভাবক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও ইতিবাচক এবং আশাবাদী। যদিও গত একবছরে আমার পুত্রের বেসিক লেখাপড়ার অবনতি ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
কারিকুলাম সম্পর্কে, মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে ছাত্র- শিক্ষকদের স্পষ্ট ধারণা না থাকায় তাঁরা এ কারিকুলামে অন্তত এখন পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে বলে মনে হয় না।
নতুন পদ্ধতি, সবকিছু বুঝে উঠতে হয়তো আমাদের আরও সময় প্রয়োজন। তবে সবার আগে সম্মানিত শিক্ষকদের এ পদ্ধতিকে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হবে, বুঝতে হবে সম্মানিত অভিভাবকদেরও। আমাদের দেশের শিক্ষার গতানুগতিক ধারা ছিল শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দান করেন আর শিক্ষার্থীগণ তা গ্রহণ করে। শিক্ষকগণ সাধারণত বক্তব্যনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ক্রিয়াকলাপে যুক্ত করে তাদের ভিতরকার সৃজনশীল শক্তিকে তীক্ষ্ণ করার চেষ্টা খুব কম শিক্ষকই করতেন। এটা শিক্ষকদের দোষও নয়; এটা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও পাঠ্যক্রমের সমস্যা ছিল।
তবে খুবই আশার কথা যে - নতুন কারিকুলামে ক্রিয়াকলাপভিত্তিক শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে আলাদা আলোচনার ইচ্ছে রইল।
হাসি আনন্দের মাধ্যমে বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের মধ্যে দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষা লাভ করতে পারলে তারা সহজেই সুনাগরিক অর্থাৎ স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে তৈরি হবে।
এ পদ্ধতিতে হাসি আনন্দের মাধ্যমে লেখাপড়া করে ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ যা-ই অর্জন হোকনা কেন শিক্ষার্থীদের বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞানার্জন সম্ভব বলে আমার এখনও মনে হয়। এজন্য মূল্যায়ন পদ্ধতি সহজবোধ্য করা এবং শিক্ষকদের ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। আমার সন্তানের বাংলা ও ইংরেজি বই এবং শিক্ষকদের টিজি দেখে গ্রামার শেখার বা শেখানোর খুব ভালো কোনো স্পেস আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি দেখতে পাইনি। সঠিকভাবে গ্রামার শিক্ষা বিহীন ভাষা শিক্ষা অনেকটাই কঠিন। তাই নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষকদের এবিষয়ে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।
ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ ডিজাইন করা আর রাজ মিস্ত্রিদের কাজ ডিজাইন বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সে ডিজাইন মিস্ত্রিদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। কারন শিক্ষকদের অনেকাংশই সেই বক্তব্য নির্ভর শিক্ষা দানের পদ্ধতিতে আটকে আছেন আজও।
একজন ক্ষুদ্র শিক্ষক হিসেবে আমি অবশ্যই মনে করি সরকার নির্ধারিত কারিকুলাম বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করাই শিক্ষকদের কাজ। তবে বাস্তবায়নে শিক্ষকগণ কী কী অসুবিধা মোকাবিলা করছেন সে বিষয়ে চিন্তা করাও প্রয়োজন।
পরিশেষে বলতে চাই - বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের জন্য নিজ দায়িত্বে পড়াশোনা করার কোনো বিকল্প নেই - এটা আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মাথায় রাখতে হবে। আশাকরি ব্যাগ ভর্তি বই, টেবিল ভর্তি নোট গাইড, প্রাইভেট, কোচিং, সারারাত পাঠ মুখস্থকরণ ইত্যাদি থেকে বের হয়ে অন্যরকম ভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
এ পদ্ধতিকে বুঝে উঠে এর সুফল পেতে হয়তো আরো কিছুটা সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। একজন অভিভাবক হিসেবে সে অপেক্ষায় রইলাম।
What's Your Reaction?