পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আতঙ্কিত নাম কে এই নাথান বম

মো: সিরাজুল মনির,চট্রগ্রাম ব্যুরো
Apr 7, 2024 - 13:16
 0  13
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আতঙ্কিত নাম কে এই নাথান বম

পার্বত্য চট্টগ্রামের আতঙ্কিত এক নাম নাথান বম। কে এই নাথান বম তার ইতিহাস উদ্ধার করতে গিয়ে জানা যায় 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা উপজেলার এডেনপাড়ার নিজ এলাকায় ফিরে গিয়েছিলেন নাথান বম। এরপর পাহাড়ি জনজীবন উন্নয়নে কাজ করা আন্তর্জাতিক একটি সংস্থায় চাকরির চেষ্টা করেন। মাঝে একটি রিসোর্টও চালু করেছিলেন তিনি। এরপর ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-কেএনডিও’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গড়ে তোলেন। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া বম জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন নাথান বম। সেই কেএনডিও একপর্যায়ে রূপান্তরিত হয় সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টে (কেএনএফ)। পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

রুমার এডেনপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কেএনডিও সৃষ্টি করে এর প্রধান হন নাথান বম। তাকে কেন্দ্র করেই একসময় সেটি সশস্ত্র গ্রুপে রূপ নেয়। শুরুতে এই সংগঠন নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ায় তারাও ছিলেন আনন্দিত। ২০১৯ সালের দিকে ওই সংগঠনের আড়ালে নাথান বমের ভয়ংকর রূপ সামনে আসে রুমা এলাকার বাসিন্দাদের কাছে। কেএনএফের অপতৎপরতা শুরু হলে বিব্রত হন তারা। সংগঠনটির সাম্প্রতিক বিভীষিকা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পাহাড়ের বাসিন্দারা যেমন আতঙ্কিত, তেমনি আতঙ্কে বম সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকজনও।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য জুয়েল বম বলেন, ‘নাথান বমকে নিয়ে তারা সবাই বিব্রত।’ পলাতক নাথানের শুরুর দিকের অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, যখন তার (নাথানের) অপকর্ম সামনে আসতে থাকল, তখন থেকেই তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরপর ২০১৯ সাল থেকে তাকে খুব বেশি প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে একেবারেই নিরুদ্দেশ নাথান।

তিনি বলেন, বমদের মধ্যে যারা বিপথে গেছে, তাদের কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফেরার একটা পথ তৈরি হয়েছিল। একটা শান্তি আলোচনা চলছিল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে। কিন্তু এর মাঝে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটল, তা শান্তি প্রক্রিয়াকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে।

শুরুর দিকে বম সম্প্রদায়ের যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করা, পরে পাহাড়ে তৎপর রাজনৈতিক সংগঠন জেএসএস এবং চাকমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো কাজ হয়ে ওঠে নাথানের কেএনএফের। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর রূপ। পাহাড়ের অধিবাসীদের ধরে এনে নির্যাতন, হত্যাসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আলোচনায় থাকে সংগঠনটি। ২০২২ সালের দিকে ফেসবুকে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণা দিয়ে বেশ আলোচনায় আসে সংগঠনটি। ওই বছরের অক্টোবরে জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল আনসার আল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র চুক্তির বিষয়টি সামনে আসে র্যাবের অভিযানে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে ব্যাংক লুট, অপহরণ আর থানা আক্রমণ চেষ্টায় কেএনএফ বড় আতঙ্ক ছড়ায়।

গত মঙ্গল ও বুধবার বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র কেএনএফ সদস্যরা। তারা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানের থানচি বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে কেএনএফ সদস্যদের প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলি হয়।

আলোচনায় আসতে পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কেএনএফের: কয়েক বছর ধরে কেএনএফ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালেও মূলত ২০২২ সালের শুরুর দিকে সংগঠনটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ওই বছর ফেসবুকে পেজ খুলে এই শসস্ত্র গোষ্ঠী তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। কেএনএফ ফেসবুক পেজে দাবি করে, রাঙামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি—এই ৬ জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম—এই উপজেলাগুলো নিয়ে আলাদা রাজ্যের দাবি করে কল্পিত রাজ্যের মানচিত্রও প্রকাশ করা হয় ফেসবুকে। এরপর তারা নানা সময়ে ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট করে আসছে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, সক্ষমতা প্রদর্শন করা। হয়তো কেএনএফ তাদের সমর্থক ও প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দেখাতে চাইছে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী।

তিনি বলেন, ‘কেএনএফ সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই লক্ষ্যে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কাজ করছিল। এর মধ্যেই তারা এ ধরনের কার্যকলাপ করছে। কেএনএফ সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট, পুলিশ ক্যাম্পে গুলিবর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালিয়েছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না, যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলছে

নাথান বম কোথায়?: এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যে সংগঠনের প্রধানের নাম, সেই নাথান বম এখনো অধরা। তার দলে অস্ত্র আর অর্থের জোগান আসে কোথা থেকে—তাও পরিষ্কার নয়। তিনি কোথায় আছেন, জানে না কেউ। অবশ্য স্থানীয় মানুষ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, মোস্ট ওয়ান্টেন্ড নাথান বম প্রতিবেশী দেশের রাজ্য মিজোরামে অবস্থান করে থাকতে পারেন।

স্থানীয়রা বলছেন, এই নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক শেষ করেন। পরে নিজ এলাকায় গিয়ে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থায় চাকরির চেষ্টা করেন। তখন তার চাকরি না হলেও চাকমা জনগোষ্ঠীর কয়েকজনের চাকরি হয়। এতে তার ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে তিনি এলাকায় একটি রিসোর্ট তৈরি করে পর্যটন ব্যবসায় নাম লেখালেও তাতে লোকসান হলে তা বন্ধ করে দেন। তবে তার এনজিও কেএনডিও চলছিল।

পাহাড়ে তার পরিচিতজনরা বলছেন, নাথান মূলত নিজের গড়া এনজিও কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (কেএনডিও) আড়ালে সশস্ত্র সংগঠনের জন্য কর্মী সংগ্রহ করেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, ২০১৮ সালের শেষদিকে নাথানসহ বেশ কয়েকজন মিয়ানমারের চিন রাজ্যে গিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন। পরে তারা এলাকায় ফিরে আসেন। ওই বছর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্রও তোলেন। তবে বাছাইয়ে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। ২০১৯ সালের দিকে তার কর্মকাণ্ড অনেকের চোখেই সন্দেহের সৃষ্টি করে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন। এরপর মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও ২০২২ সালের শুরুর দিকে একেবারে হাওয়া হয়ে যান তিনি।

গতকাল শনিবার বান্দরবান পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘একটি সশস্ত্র সংগঠন তাদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা মনে করি যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে অপরাধ করেছে। কাজেই রাষ্ট্র চুপ থাকতে পারে না। আমরা এ জন্য যা যা করণীয় তা করব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমরা পুলিশ, র‍্যাব, আনসার সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করব। আমরা সীমান্তে বিজিবি বৃদ্ধি করব।

তিনি বলেন, ‘যারা এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তারা যদি বিদেশেও আশ্রয় নেয়, আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের দেশে ফেরত এনে বিচারের ব্যবস্থা করব।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘কোনো ধরনের অস্ত্রধারীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকতে দেব না। আমরা অনেক ধৈর্যের সঙ্গে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তাদের সঙ্গে দুবার আলোচনায় বসেছেন। তারা আলোচনায় না গিয়ে তাদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছে। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। আদিবাসী জনগণ অনেকটাই এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে ভয়ে। জীবন রক্ষার্থে অনেকেই বান্দরবান সদরসহ বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে শুরু করেছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow