৮ বছর ধরে বিদ্যুৎহীন সুবর্ণচরের তিন গ্রাম, দাঁড়িয়ে আছে শুধু খুঁটি

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছালেও নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার ৮ নম্বর মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ বাসিন্দা দীর্ঘ আট বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎবঞ্চিত। ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ অংশ এবং ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় এক হাজার গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎ সংযোগের অপেক্ষায় আছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর অবহেলার কারণে বন বিভাগের রোপিত গাছের ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন করা হয়। ফলে লাইন চালু হওয়ার আগেই গাছগুলো বড় হয়ে যায়, যা সংযোগ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করতে হলে গাছ কাটতে হবে, কিন্তু বন বিভাগ এতে আপত্তি জানিয়ে মামলা করে। এরপর ঠিকাদার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে কাজ না করেই এলাকা ছেড়ে চলে যান, ফলে সংযোগ চালু করা সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি বিদ্যুৎ সংযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও তারা কোনো পদক্ষেপ নেননি।
২০২৩ সালের আগস্টে সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী এক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ চালুর ঘোষণা দেন। সুবর্ণচর উপজেলা বিদ্যুৎ সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান দীপক ১০ দিনের সময় নেন। এরপর বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা মাঠে নেমে সংযোগ চালুর প্রস্তুতি নেন। কিন্তু দুর্বৃত্তরা লাইনের বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি করায় তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া গাছ কাটতে গেলে বাধা দেওয়া হয়। অনুমতি চাওয়া হলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনাগ্রহের কারণে আবেদন অনুমোদিত হয়নি।
সরকার পতনের এক মাস আগে বন বিভাগ গাছ গণনা করে কর্তনের জন্য লাল চিহ্ন দিয়ে রাখলেও পরবর্তীতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগ ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি ফেলে রেখেছে।
স্থানীয়দের মতে, বিদ্যুৎ সংযোগের আশায় অনেকেই ঋণ নিয়ে বা ফসল বিক্রি করে ঘরের ওয়্যারিং করিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ ২০ মাসেও সংযোগ চালু না হওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন।
হেলাল উদ্দিন নামে এক যুবক বলেন, "বিদ্যুতের আশায় দোকান দিয়েছি, কিন্তু আলো দেখতে পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে জেনারেটরের মাধ্যমে দোকান চালাচ্ছি।"
কামাল নামে এক বিএনপি নেতা জানান, "তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মাধ্যমে প্রতিটি খুঁটি বাবদ ৫০০-১০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে, কিন্তু তারপরও লাইন চালু হয়নি।"
আমেনা নামের এক গৃহবধূ বলেন, "বিদ্যুতের আশায় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ঘর ওয়্যারিং করেছি, ফ্যান কিনেছি। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্যান বাবার বাড়িতে রেখে এসেছি।"
স্থানীয় একটি এনজিও ‘নিজেরা করি’-এর প্রতিনিধি সুরেশ কর্মকার জানান, "আমরা ঈদের পর মানববন্ধন করব এবং জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেব।"
বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, "সরকার পরিবর্তনের পর এ বিষয়ে কেউ আমাদের কাছে আসেনি। যদি আবেদন পাই, তাহলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গাছ কাটার ব্যবস্থা করা হবে।"
সুবর্ণচর উপজেলা জোনাল অফিসার জানান, "আমি নতুন এসেছি। কেউ বিষয়টি জানালে বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক বলেন, "বিষয়টি আগে জানতাম না। এখন শুনলাম, দ্রুত দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করব।"
দীর্ঘ আট বছর ধরে তিন গ্রামের এক হাজারেরও বেশি মানুষ বিদ্যুৎবঞ্চিত। প্রতিবার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন—"আর কতদিন এভাবে অন্ধকারে থাকতে হবে?"
What's Your Reaction?






